বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম। আমার ব্লগ এ একটা বাংলা সেকশন তৈরি করব। নানা কাজের চাপে সেটা আর হয়ে উঠছিল না। তাই আজকে ভাবলাম করেই ফেলি। তারপর ভাবলাম, কি লিখি , কি লেখা যায়। হটাৎ মনে হলো আজ তো মহালয়া। আমার জীবনে মহালয়া গুলো কেমন কেটেছে সেটাই না হয় আজকে লেখা থাক এখানে। সময়ের টানে স্মৃতি আরো দুর্বল হয়ে যাওয়ার আগেই না হয় কালির টানে আর একটু না হয় সময় চেয়ে নেওয়া যাক মহাকালের থেকে।
আমরা যারা আশির দশকে বা তার কাছাকাছি জন্মেছি। তারা এক অদ্ভুত সময়ের সাক্ষী। অর্ধেকটা জীবন আমরা কাটিয়েছি যেখানে কোনো মোবাইলে ফোন , সোশ্যাল মিডিয়া এমন কি স্যাটেলাইট টিভির ও অস্তিত্ব ছিল না। আমাদের স্কুল জীবনে একটা রচনা খুব আসতো, "বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ"। কেন জানি না প্রশ্নটা আজও আমায় খোঁচায়। যাক গে, এসব তত্ত্বকথা পরে হবে কোনো একদিন। আজকে শুধুই মহালয়া।
আমার জীবনের অনেকটাই কেটেছে একটা ছোট্ট শহরতলিতে। কোলকাতা থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে একটা শান্ত শহর, বসিরহাট। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। আর তাতে ভেসে থাকা নৌকাদের ভিড়। নদীর পাড় ধরে গাছেদের সারি। আর দশটা পাঁচটা মফস্বল টাউন যেমন হয় এটাও তেমনি। তবে ছোট শহর বলে কিনা জানি না সবাই সবাইকে চিনতেন জানতেন। ধর্ম কিংবা রাজনৈতিক মতপার্থক্য কখনো সৌজন্যবোধকে অতিক্রম করে যেত না। বসিরহাট হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক কে দেখে আমার বাবা কে সিগারেট ফেলে দিতে দেখেছি। কিন্তু বাবা না সেই স্কুল এর ছাত্র ছিলেন, না উনি আমার বাবার কোনো ভাবে শিক্ষক ছিলেন। হয়তো সেটাই তখনকার সৌজন্য বোধ ছিল।
স্মৃতি বড়ো অবাধ্য। বার বার এদিক ওদিক নিয়ে যায় মনকে। তা যা বলছিলাম, আমার বাবা অনেক জায়গায় ভাসতে ভাসতে কর্মসূত্রে বসিরহাট এসে পৌঁছান। আমার জন্মও এই শহরে। আমার মা ছিলেন শিক্ষিকা। আমার যখন প্রায় ৬ বা ৭ বছর বয়স তখন আমরা আমাদের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম, সেটাও বসিরহাট এ। আমি এমনিতেই বড্ডো ঘুম কাতুরে। সকালে আমায় ওঠানো আর কুম্ভকর্ণ এর ঘুম ভাঙানোর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য থাকতো না । সে একপ্রস্থ যুদ্ধেরই সমান। আমাদের একটা বেশ বড় পুরোনো খাট ছিল তাতে বাবা , মা আর আমি শুতাম। তখন পুজোর আগে ভোর এর দিকটা হালকা করে ঠান্ডা পরে যেত। স্থানীয় ভাষায় আমরা বলতাম হিম পড়া। বাবার একটা পুরোনো philips এর রেডিও ছিল, তার গায়ে লেখা ছিল made in Holland । শুনেছি ওটা নাকি আমার ও জন্মের অনেক বছর আগে কেনা। ওই সময় ওটা আমাদের কাছে একটা গর্বের বস্তু ছিল। বাবাকে আমি কোনো দিন এলার্ম লাগিয়ে শুতে দেখি নি। মহালয়ার দিন ভোর চারটে নাগাদ বাবা উঠে যেতেন। আগের দিন রাত্রে রেডিও কে পরিষ্কার করে তার কর্মক্ষমতাকে পরীক্ষা করে সাজিয়ে রাখা আছে কাঠের টুল এর উপর। বাবা চালিয়ে দিতেন রেডিও টা খুব আস্তে করে যাতে মা এর ঘুম না ভেঙে যায়। বাবা তারপর এসে শুয়ে পড়তেন আবার। কেন জানি না ওই একটা দিন আমার ঘুম নিজে থেকেই ভেঙে যেত বাবার সাথে সাথে। আমি গুটিসুটি মেরে বাবার চাদরের তলায় ঢুকে যেতাম। বাইরের হিম হওয়া আর বাবার শরীরের ওম লেগে থাকা আমি । কানে ভেসে আসছে মহালয়ার সুর আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ। মনের মধ্যে একটা অনাবিল আনন্দ । আর মাত্র সাত দিন । মা আসছেন। সব কিছু ভুলে তিনটে দিন শুধুই আনন্দ। ভাললাগা। সব চেয়ে বড় কথা কেউ পড়তে বসতে বলবে না। এটাই যেন পুজোর আনন্দকে দশগুণ বাড়িয়ে দিত। সেই শুয়ে শুয়ে মহালয়া শোনার আনন্দ টা এখনো ম্লান হলো না। বাড়ির দরজার পাশে থাকা শিউলী গাছের তলায় পরে থাকা সাদা শিউলী ফুলের থোকা দু হাত ভরে তোলার অনুভূতিটা হয়তো এ জীবনে আর পাবো না। স্মৃতিতে মিশে থাকা গন্ধ টাই শেষ সম্বল।
প্রায় দু ঘন্টা ধরে চলত রেডিও তে মা দুর্গার সাথে মহিষাসুর এর সে এক ভীষণ যুদ্ধ। কথা আর সুরের প্রতিটা বর্ণনায় যেন চোখের সামনে ভেসে উঠতো ঘটনাগুলো। দেবীর আবির্ভাব থেকে , অস্ত্র দান কিংবা সেই ভয়ানক যুদ্ধের দৃশ্য। সে এক নিজের কল্পনার জগৎ। মা দুর্গা প্রায় যখন বধ করে ফেলেছেন মহিষাসুর কে , আমার মা তখন উঠতেন ঘুম থেকে। উঠেই প্রথম কথা এটাই বলতেন , " এই যা, মহালয়া শুরু হয়ে গেছে আমায় তোমারা ওঠাওনি কেন"। বাইরে আস্তে আস্তে রোদের আভাস। মহালয়ার ভোর যে এবার দিনে পরিণত হচ্ছে।
সকালের জলখাবারে (breakfast তখনও জীবনের হানা দেয়নি) সাদা ফুলকো লুচি আর সঙ্গে আলুমরিচ এর সাদা তরকারি। তার স্বাদ এখনো অম্লান। পরে ঘরে তৈরি গুড়ের নাড়ু উপরি পাওনা। কোনোমতে খাবার খেয়েই ছুটে মা এর কাছে। আগে থেকে বলা আছে আজকে পড়াশুনা বন্ধ। কিন্তু মন পরে আছে তো সেই পূজাবার্ষিকী গুলোর জন্য যারা এতদিন মার আলমারিতে শাড়ির ভাঁজে আটকে আছে। আনন্দমেলা, শুকতারা, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, কিশোর ভারতী তারা যে সব আমায় ডাকছে। প্রতিবছর মহালয়ার দিনই তারা আমার হস্তগত হতো। তার আগে পরীক্ষার জন্য মা তুলে রাখতেন । সে যেন এক মহাবিশ্বের দরজা খুলে যাবার সমান ছিল আমার কাছে। কাকে ছেড়ে কাকে পড়ি। কাকাবাবু আর সন্তু নাকি প্রফেসর শঙ্কুর নতুন অভিযান। ওদিকে পাণ্ডব গোয়েন্দার এডভেঞ্চার শুরু হয়ে গেছে । আবার ঘনাদা যথারীতি লেকের ধরে জমিয়ে বসে গেছেন। কাকে আগে যে শুরু করি বুঝতেই পারতাম না।
এসবের ফাঁকে কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চললো খেয়ালই থাকতো না । মা এর গুঁতো খেয়ে মনের কষ্ট মনে রেখে যেতাম চান করতে। পুকুরে এক জাম্প মেরে এক ডুবে চান সেরেই দৌড়। প্রফেসর শঙ্কু যে সবে পিরামিড এর ভিতর ঢুকেছেন। প্রাণ যে হাঁকপাঁক করছে তারপর কি হলো জানার জন্য। কিন্তু উপায় নেই। আগে খাওয়া তারপর বাকি সব। আমাদের বাড়ির নিয়ম ছিল আমরা সবাই এক সাথে খেতে বসতাম। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় আমাদের বাড়িতে Dining table আসেনি। তাই মেঝেতে আসন পেতে খেতে বসতাম। আমি, বাবা আর কাকা। মা সবাই কে দিয়ে নিজেও বসতেন। কত গল্প আর হাসি এমনিই থাকতো সেই সব সাধারণ দিন গুলোর মধ্যে এখন অনুভব করি।
আর এক বছরের ঘটনা বলি। তখন রেডিও এর পরে টিভি তে মহিষাসুরমর্দিনী দেখা সবে শুরু হয়েছে সবে সবে। বাবার পাশে জাঁকিয়ে বসে হাঁ করে দেখছি । তখন প্রায় সকাল শুরু হয়ে গেছে। হটাৎ মা ভীষণ ভাবে উত্তেজিত হয়ে এসে বাবা কে বললেন,
" যা সব শেষ হয়ে গেল।"
আমার বাবা চিরকাল ধীর স্থির প্রকৃতির ছিলেন তাই খুবই সাধারণ ভাবে বললেন,
" কেন কি হলো আবার।"
আমি পুরোটা না বুঝলেও এই টুকু বুঝলাম যে । আমাদের পাড়ার এক জামাইবাবু ( সেই সময়টায় পাড়ার দিদি বা জামাইবাবুরাও ততধিক সম্মান পেতেন আমরা যতটা নিজের লোকেরা পেত। সম্পর্কগুলো তখন রক্তের সীমারেখায় বাঁধা থাকতো না) কাউকে না বলে একটা পুরুত ধরে নিয়ে এসে আমাদের পুকুরে তর্পণ শুরু করে দিয়েছে। সত্যিই বলতে কি সেই বয়সে আমার কোনো ধারনাই ছিল না তর্পণ জিনিষটা আসলে কি। বাবা ছিলেন সক্রিয় কম্যুনিস্ট তাই ঈশ্বর এর প্রতি বিশ্বাসটা কখনো ধার্মিক প্রক্রিয়া দিয়ে প্রকাশ হতো না। তাই আমি কোনোদিন এসব হতে দেখিনি। যাই হোক যা হবার তা ততক্ষনে হয়ে গেছে। সেই জামাইবাবুকে ডেকে বলা ও হলো তিনিও দুঃখপ্রকাশ করে চলে গেলেন। বাবা আমাদের আগের পাড়ার নিতাই ঠাকুর কে ডেকে পাঠালেন । তিনি স্বস্তি স্বাস্ত্যান করে পুকুর আবার শুধ্য করে দিলেন। এক পর্ব মিটল। কয়েক মাস পরে সেই জামাইবাবুকে আমাদের বাড়িতে বসে চা খেতে খেতে বাবার সাথে গল্প করতে দেখেছি। কোনো বিরূপ মনোভাব নিয়ে দিনের পর দিন থাকাটা হয়তো সেই সময়ের চল ছিলনা।
আমাদের শৈশবটা কি অপার বিষ্ময় কেটে যেত। রঙ্গন ফুলের থোকায় বসা প্রজাপতির ডানায় পড়া সূর্যের আলোর রামধনু খোঁজার ভালোলাগাটাকে আজও কেউ খুঁজে এনে দিতে পারলোনা ।
এমনি ভাবেই দিনগুলো কেটে যেত হাসি কান্নায়। তবে আজ মনে হয় সেদিন এর সেই ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারে হয়তো প্রাচুর্য ছিলোনা, কিন্তু একটা মায়া লেগে থাকা পরিবার ছিল। আকারণের প্রতিযোগিতা ছিল না তাই হয়তো হাঁপিয়ে পড়ার ক্লান্তিটাও ছিল না।
আজ অনেকটা সময় বয়ে গেছে । কালের টানে বদলে গেছে অনেক কিছুই। বাংলাভাষা আজকে একটা প্রায় অবলুপ্ত ভাষায় পরিণত হতে চলেছে। হয়তো আমাদের প্রজন্ম এর সাথেই শেষ হবে এই সব স্মৃতি আর তার সাথে হয়তো এই ভাষারও।
আগের দিনগুলো ভালো ছিলো না খারাপ ছিল আমি জানি না। আমি জানতেও চাই না। হয়তো জানাও যায় না। শুধু জানি সেদিনের সেই ভালোলাগা গুলো কে আজ ও কেউ ভোলাতে পারেনি। এখনো যেন কালকের ঘটনার মতো জ্বলজ্বল করছে।
তবে এটাও জানি সবটাই অন্ধকার নয় , আজ আমার মতো অনেকেই আছে যারা নিজের শহর থেকে কর্মসূত্রে অনেক দূরে থাকেন । তাদের কে থাকতে হয় জীবিকার টানে। কিন্তু এই মহালয়ার দিন বা পুজোর কটাদিন তাদের থেকে তাদের বাঙালিয়ানা কেউ কেরে নিতে পারে না। তাই কোনো অতিমারীর ও ক্ষমতা নেই , আমাদের মন থেকে পুজোর আনন্দ কে সরিয়ে দেবার। হয়তো জাঁকজমক কম হবে। পুজোর আড্ডাটা পাড়ার প্যান্ডেল থেকে উঠে google meet এ হবে। কিন্তু হবে। পুজোর ভোগ থেকে মন্টুদার চিকেন রোল ও হবে। রাস্তায় না হোক বাড়িতে হবে। এবারের পুজো তো সবার পাশে থাকার পুজো। হার না মানার পুজো।
সবাই কে পুজোর আগাম শুভেচ্ছা।
ভালো থাকবেন । ভালো রাখবেন।
Comments